কক্সবাজার সৈকতে দুই দিনে ভেসে এল ৬৮টি মৃত কচ্ছপ

একের পর এক মৃত কচ্ছপের দেখা মিলছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। গতকাল শনিবার ও আজ রোববার এই দুই দিনে ভেসে এসেছে ৬৮টি মৃত কচ্ছপ। মৃত কচ্ছপগুলো জলপাই রঙের বা অলিভ রিডলি প্রজাতির বলে গবেষকেরা জানিয়েছেন। প্রজনন মৌসুমে এভাবে কচ্ছপের মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদেরা।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া জানান, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে গত দুই দিনে ভেসে এসেছে ৬৮টি মৃত কচ্ছপ। এর আগে ৪ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে এসেছে আরও ১৪টি মৃত কচ্ছপ। ফলে গত ২৪ দিনে মোট ৮৪টি মৃত কচ্ছপ ভেসে এসেছে।

অথচ গত বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গিয়েছিল। প্রজনন মৌসুমে এবার এত সংখ্যক কচ্ছপের মৃত্যু চিন্তিত করে তুলেছে গবেষকদের। তাঁরা বলছেন, এভাবে কচ্ছপের মৃত্যু, তাদের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন এলাকায় কিছু সংখ্যক কচ্ছপের মৃতদেহ পড়ে থাকার খবর দেন স্থানীয় লোকজন। এ তথ্যের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউটের একটি গবেষক দলের সদস্যরা শনিবার সকাল থেকে সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে যান। গবেষক দলের সদস্যরা শনিবার টেকনাফ উপজেলার সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়ার রূপপতি এলাকা পর্যন্ত ১২টি কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। গতকাল রূপপতি থেকে সোনারপাড়া পর্যন্ত ৪৯টি এবং প্যাঁচার দ্বীপ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সাতটি কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করেন তাঁরা।

বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় মা কচ্ছপ উপকূলে ডিম দিতে আসে। তখন অনেক কচ্ছপ জেলেদের জালে আটকে, সমুদ্রে চলাচলকারী বড় নৌযানের ধাক্কায় মারা যায়। তবে তদন্তের পর কচ্ছপগুলোর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব হবে।

সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফ সৈকতে অন্তত ২৯টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া গিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে ৩টি মৃত ডলফিনও ভেসে এসেছিল।

প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) বলছে, সামুদ্রিক মা কচ্ছপ এখন মহাবিপদে রয়েছে। ১০ বছর আগে ২০০৩ সালে সংস্থাটির এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসত। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে নিরাপদ ছিল।

নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, ১০ বছর আগে ৫২ পয়েন্টে মা কচ্ছপ ডিম দিতে এলেও বর্তমানে কমে ৩৪ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় এসব কচ্ছপ ডিম দিত। সমুদ্রপাড়ে ডিম দিতে এসে পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখন ব্যাহত হচ্ছে। ডিম দিতে এসে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ।

নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজার সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদি কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। ক্রমাগত কচ্ছপের ডিম দেওয়ার স্থান কমছে।

আবদুল কাইয়ুম আরও বলেন, মা কচ্ছপগুলো ডিম দিতে সমুদ্র থেকে উপকূলে আসা-যাওয়ার পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে সৈকতে পুঁতে রাখা মাছ ধরার অবৈধ কারেন্ট জালের কারণে। গভীর সাগরে ট্রলিং জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে মা কচ্ছপ। কচ্ছপ সৈকতে এসে ডিম পাড়তে পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে কুকুর। ডিম পাড়তে উঠলেই মা কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সংঘবদ্ধ কুকুর। ফলে মা কচ্ছপ মহাবিপদে পড়েছে।

পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, প্রতিবছর প্রজনন মৌসুমে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। জোয়ারের পানিতে কচ্ছপগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলেছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি, তা না হলে কচ্ছপ রক্ষা করা যাবে না।

Post Comment