মক্কা—ইসলামের হৃদয়স্থান। এ শহর শুধু কাবার কারণে নয়, বরং বহু নবীর স্মৃতি বহন করায় মুসলমানদের কাছে অপরিসীম পবিত্র।হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর হাতে গড়া এই নগরীতে তাঁর সন্তান ইসমাইল (আ.) ও ইসহাক (আ.) বড় হয়েছেন, এবং এখানেই তাঁরা জীবনযাপন করেছেন। এ বংশ থেকেই এসেছেন বহু নবী, আর সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কাতেই জন্মগ্রহণ করেন।এই শহরের বুকে আছে এমন বহু স্থান ও বস্তু, যা নবীদের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে চলেছে যুগের পর যুগ। আসুন, মক্কার কিছু স্মরণীয় পবিত্র স্থান সম্পর্কে জানি।কাবাঘর: ইবাদতের প্রথম কেন্দ্রকাবা শরিফ ইসলামি ইতিহাসের প্রাচীনতম ও সর্বপ্রথম ইবাদতস্থান, যা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং ইসমাইল (আ.) নির্মাণ করেছিলেন।বর্তমান কাবার উচ্চতা বিভিন্ন দিকে ভিন্ন, এর অভ্যন্তরে রয়েছে রঙিন মার্বেল পাথরের মেঝে এবং তিনটি কাঠের স্তম্ভ। ভেতরের দেয়াল সবুজ পর্দায় আবৃত থাকে এবং ছাদে একটি সূর্যালোক প্রবেশের ছোট খোলা অংশ আছে।প্রতি বছর ৯ জিলহজ কাবার গিলাফ (কালো কাপড়) পরিবর্তন করা হয়, যা রেশম দিয়ে তৈরি এবং সোনার সূচিকর্মে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ইত্যাদি লিখিত থাকে। এর ওজন প্রায় ৬৭০ কেজি রেশম ও ১৫ কেজি সোনা।জমজম কূপ: বরকতের নিরন্তর স্রোতকাবার পাশে অবস্থিত জমজম কূপ হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের নিচ থেকে উৎসারিত হয় জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে।মা হাজেরা (আ.) যখন পানি খুঁজে সাফা-মারওয়ার মাঝে ছোটাছুটি করছিলেন, তখন আল্লাহর আদেশে জমজমের সৃষ্টি হয়।রাসুল (সা.) জমজমের পানি সম্পর্কে বলেছেন— “এটি বরকতময় পানি, যা ক্ষুধার জন্য খাদ্য ও রোগীর জন্য আরোগ্য।” এই পানির ব্যবহার ওজু ও গোসলের জন্য বৈধ হলেও ইস্তিঞ্জার কাজে ব্যবহার অনুচিত।মাকামে ইব্রাহিম: নবীর পায়ের ছাপ বহনকারী পাথরএই পাথরে দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.
) কাবাঘর নির্মাণ করেন। আজও সেখানে তাঁর দুটি পায়ের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখা যায়।পাথরটির দৈর্ঘ্য আধা মিটার এবং এটিকে ঘিরে রয়েছে সোনার আবরণযুক্ত একটি কাঁচের খাঁচা। তাওয়াফ শেষে মুসল্লিরা এখানেই দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ।রাসুল (সা.) বলেছেন, “মাকামে ইব্রাহিম জান্নাতের মুক্তার মতো, আল্লাহ তার আলো নিভিয়ে দিয়েছেন।” (তিরমিজি)হেরা গুহা: নবুয়তের সূচনা স্থলমক্কার উত্তরে অবস্থিত হেরা পর্বতের এক গুহায় ওহি নাজিল হয় এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুয়ত লাভ করেন। এটিই সেই গুহা যেখানে তিনি একাকী ধ্যানমগ্ন থাকতেন। পর্বতটি প্রায় ২০০ মিটার উঁচু এবং মক্কার মধ্যে সর্বোচ্চ।এই গুহায় বসে কাবা শরিফ স্পষ্ট দেখা যায় এবং এটি আজও মক্কা দর্শনার্থীদের জন্য পবিত্র স্মৃতিসৌধ।হাজরে আসওয়াদ: জান্নাত থেকে আগত পাথরকাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ পাথরটি জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে।প্রথমে এটি বরফের মতো সাদা ছিল, কিন্তু মানবজাতির পাপ এটিকে কালো করে দিয়েছে। (তিরমিজি) বর্তমানে হাজরে আসওয়াদ অনেক ছোট ছোট টুকরায় বিভক্ত, যা একটি রূপার বেষ্টনীর মধ্যে রাখা আছে।হজরত উমর (রা.) বলেছিলেন, "তুমি তো একটি পাথর, তোমার কোনো উপকার বা অপকারের শক্তি নেই। নবীজিকে না দেখলে আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।” (বুখারি)সাফা ও মারওয়া: মা হাজেরার ত্যাগের চিহ্নসাফা ও মারওয়া দুইটি ছোট পাহাড়, যেখান দিয়ে মা হাজেরা (আ.) বারবার ছোটাছুটি করেছিলেন পানি খুঁজে।হজ ও উমরাহর সময় মুসল্লিরা এই দুই পাহাড়ের মাঝে ‘সাঈ’ করেন, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। সাফা থেকে কাবাঘর দেখা যায়, তবে মারওয়া থেকে বর্তমানে দেখা যায় না। পাহাড়দ্বয় আধুনিক কাঠামোর মাধ্যমে সংরক্ষিত। মক্কা শুধু একটি শহর নয়—এটি নবীদের পদধূলিতে ধন্য, ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে পবিত্র এক ভূমি। প্রতিটি পাথর, প্রতিটি স্থান যেন গল্প বলে ঈমান, ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাসের।
মন্তব্য (০)