আত্মহত্যা একটি মানবিক দুর্যোগ। মানুষের জীবনে নানা রকম চাপ ও অসহায়তা থেকে জন্ম নেয় এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কিন্তু যখন প্রশিক্ষিত, দায়িত্বশীল, ও সেবাপ্রত্যাশী পেশাজীবী, যেমন একজন পুলিশ সদস্য আত্মহত্যা করেন, তখন বিষয়টি হয়ে ওঠে আরও বেশি শঙ্কার ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।সম্প্রতি সাভারে এক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার মরদেহ তাঁর অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়, যেটিকে প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে শরীয়তপুর, পটুয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ সদস্যদের আত্মহননের ঘটনা বারবার সামনে এসেছে।প্রশ্ন হলো—কেন একজন পুলিশ সদস্য, যিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে সজ্জিত, এমন একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হন?পারিবারিক কলহ নাকি পেশাগত স্ট্রেস?বেশিরভাগ আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে উঠে আসে ‘পারিবারিক সমস্যা’, ‘প্রেমঘটিত সম্পর্ক’, বা ‘মানসিক রোগ’—এমন সাধারণ কারণ। কিন্তু বাস্তবতা কি শুধুই এতটুকু? একজন পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যার পেছনে পেশাগত অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত দায়িত্ব, কর্মঘণ্টার সীমাহীনতা এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন—এসবই একত্রে দায়ী হতে পারে।বিয়ের ওপর বিধিনিষেধ: একটি মানবিক সংকটনিম্নপদে নিয়োজিত কনস্টেবল ও সাব-ইন্সপেক্টরদের বিয়েতে রয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। চাকরির শর্ত অনুযায়ী তাদের অবিবাহিত থাকতে হয়, এবং চাকরি স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের অনুমতি মেলে না।ফলে, কেউ যদি প্রেমে পড়ে যায়, সেখান থেকে তৈরি হয় দ্বিধা—বিয়ে করলেই চাকরি হারানোর ঝুঁকি, আবার বিয়ে না করলে সম্পর্ক হারানোর ভয়। এই দ্বন্দ্ব অনেকের মানসিক ভারসাম্যকে চুরমার করে দেয়।২৪ ঘণ্টার দায়িত্ব আর অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টাপুলিশের পেশা এমন এক জায়গা, যেখানে কোনো নির্দিষ্ট ডিউটি আওয়ার নেই। তারা জানে না, আগামীকাল কতক্ষণ দায়িত্ব পালন করতে হবে, ছুটি মিলবে কি না, বা পরিবারে সময় দিতে পারবে কিনা।শুক্রবার বা সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও তাদের দায়িত

্ব পালনে অনুপস্থিত থাকতে হয় না বরং উপস্থিত থাকতেই হয়। ফলে পরিবার ও সামাজিক জীবনে ধীরে ধীরে তৈরি হয় দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক চাপ।শাস্তির ভীতি: মনোবল ভেঙে ফেলেপুলিশ বাহিনীতে সামান্য অভিযোগ উঠলেই বদলি বা সাময়িক বরখাস্তের মতো শাস্তি কার্যকর হয়। পরে তদন্তে দোষী প্রমাণিত না হলেও, পুরোনো স্থানে ফিরতে পারেন না অধিকাংশ সদস্য। এক তথ্যে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৬৮ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ২৩ হাজারের বেশি গুরুদণ্ড।এত বেশি শাস্তির হার কি আসলেই সদস্যদের দায়ে, নাকি একটি কঠোর কাঠামোর প্রতিফলন?মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর প্রয়োজনএকটি জরিপে দেখা গেছে, ৯৮% পুলিশ সদস্য মনে করেন, তাঁরা দায়িত্ব পালনের সময় মানসিক চাপে ভুগছেন, এবং ৯৫% মনে করেন, তাঁদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন।ঘুমের সমস্যা, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা, অবসাদ ও একাকীত্ব—এসবই দীর্ঘমেয়াদি মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দেয়। অথচ এই মানসিক চাপ প্রশমনের জন্য বাহিনীতে নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা বা সংস্কৃতি।সমাধানের পথ কী হতে পারে? বিয়ের ক্ষেত্রে অযৌক্তিক বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া নির্ধারিত কর্মঘণ্টা ও ছুটির নিশ্চয়তা মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর নিয়োগ বদলি ও শাস্তির ক্ষেত্রে মানবিকতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা সম্পূর্ণ মনিটরিংয়ের পরিবর্তে সমর্থনমুখী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা শেষ কথাপুলিশরাও মানুষ। তাদের অনুভূতি আছে, পরিবার আছে, ভালোবাসা আছে। কিন্তু দায়িত্ব পালনের পেছনে তাদের যে মূল্য দিতে হয়, তা প্রায়ই অদৃশ্য থেকে যায়। আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং তা একটি পেশাগত ও সামাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। তাই আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে শুধুই ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসেবে দেখার বদলে, পুরো সিস্টেমকে পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এখনই।