বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ সেবায় মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা কমিয়ে আনতে বড় ধরণের সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ লক্ষ্যেই প্রণয়ন করা হয়েছে ‘নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং রেজিম রিফর্ম পলিসি ২০২৫’ নামে একটি খসড়া নীতিমালা, যা ইতোমধ্যে কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে মতামতের জন্য।৩০ এপ্রিল ২০২৫-এর মধ্যে এই খসড়ার বিষয়ে নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের মতামত আহ্বান করা হয়েছে। এই সংস্কার কার্যকর হলে টেলিকম খাতের বহুস্তরীয় লাইসেন্স ব্যবস্থা অনেকটাই সরল হবে এবং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে পারবে।কেন এই সংস্কার প্রয়োজন?বর্তমানে দেশে টেলিযোগাযোগ খাতে ২২টির বেশি লাইসেন্স কার্যকর রয়েছে। ইন্টারনেট ও মুঠোফোন সেবায় বারবার উঠে এসেছে কলড্রপ, স্লো নেটওয়ার্ক, আওয়াজ কাটা পড়া ও উচ্চ মূল্যের মতো সমস্যাগুলো। অনেক সময় সেবাদাতারা অভিযোগ করেছেন, গ্রাহক পর্যায়ের মানসম্মত সেবা দিতে ব্যর্থতার পেছনে মধ্যবর্তী লাইসেন্সধারীদের অদক্ষতা দায়ী।বিটিআরসি খসড়ায় বলছে, ইন্টারনেট ও ভয়েস সেবায় আলাদা লাইসেন্সের কোনো বাস্তবিক প্রয়োজন নেই, বরং তা খরচ ও জটিলতা বাড়ায়।কি থাকছে নতুন লাইসেন্স কাঠামোতে?নতুন নীতিমালায় ২২ ধরনের লাইসেন্স কমিয়ে ৩টি স্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই তিনটি স্তর হলো:অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার (এএনএসপি)ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড কানেকটিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (এনআইসিএসপি)ইন্টারন্যাশনাল কানেকটিভিটি সার্ভিস প্রোভাইডার (আইসিএসপি)এই কাঠামোতে থাকবে মোট ৪টি লাইসেন্স এবং ২ ধরনের তালিকাভুক্তি ব্যবস্থা।এএনএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে সেবা দেবে, যেমন মোবাইল এবং ফিক্সড (তারযুক্ত) টেলিকম সার্ভিস। ফাইবার ও টাওয়ারের মতো পরিষেবা তারা এনআইসিএসপি থেকে সংগ্রহ করবে এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের জন্য আইসিএসপি-র সঙ্গে
যুক্ত থাকবে।যা থাকবে না আগের মতোবর্তমানে ব্যবহৃত আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স ও নিক্স লাইসেন্স ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব রয়েছে খসড়ায়। অর্থাৎ, এখন থেকে এই সেবা সরবরাহ করতে পারবে গ্রাহক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানেরাই।বিশেষ প্রযুক্তি ও শ্রেণিভুক্ত সেবানতুন নীতিমালায় স্টারলিংক কিংবা এনজিএসও (নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট) সেবাকে বিশেষ শ্রেণিভুক্ত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। ফলে ভবিষ্যতের উন্নত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা সরাসরি দেশে প্রবেশের সুযোগ পাবে।বিশেষজ্ঞদের মতামতবিটিআরসির কমিশনার (ইঞ্জিনিয়ারিং ও অপারেশনস) এবং সংস্কার কমিটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইকবাল আহমেদ জানিয়েছেন, "বাস্তবতার আলোকে এবং দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালাটি তৈরি করা হয়েছে।"রবি আজিয়াটার করপোরেট ও রেগুলেটরি প্রধান সাহেদ আলম জানান, “লাইসেন্সিং কাঠামোর সরলীকরণ অবশ্যই শৃঙ্খলা আনবে, তবে এর মাধ্যমে সেবার গুণগত মান ও মূল্য কতটা পরিবর্তিত হবে, তা এখনই বলা কঠিন।”দেশীয় কোম্পানিগুলোর শঙ্কাবর্তমানে দেশে ২৪টির বেশি আইজিডব্লিউ অপারেটর রয়েছে। এই খসড়ায় সরাসরি আইজিডব্লিউ ব্যবস্থা বাতিলের প্রস্তাব থাকায় ছোট দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।আইজিডব্লিউ অপারেটর ফোরামের সভাপতি আসিফ রব্বানী বলেন, “এই খসড়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কোম্পানিরাই টিকে থাকবে। আমাদের অন্তত অন্য স্তরে স্থানান্তরের সুযোগ দিতে হবে।”শেষ কথাবিটিআরসির এই খসড়া নীতিমালা টেলিযোগাযোগ খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কমলেও প্রতিযোগিতা বাড়বে, ফলে গ্রাহকরা স্বল্পমূল্যে উন্নতমানের সেবা পেতে পারেন। তবে দেশীয় ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার লড়াইও কঠিন হয়ে উঠতে পারে, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে আলোচনা।
মন্তব্য (০)