রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে চলমান উত্তপ্ত পরিবেশে প্রধানমন্ত্রী পদে কেন্দ্রীভূত অবারিত ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।গত ১১ মে নাগরিক কোয়ালিশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংলাপে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। সংলাপে উঠে আসে দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর অসীম ক্ষমতার বিষয়টি। সাত দফা সংস্কার প্রস্তাবনাগরিক জোট এই সংলাপে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে, যা বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে। তবে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার আভাস মিলেছে। অনেকেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে পূর্বে দেওয়া বক্তব্য পুনরাবৃত্তি করেছেন, যা সমস্যার সমাধানের চেয়ে অবস্থান রক্ষায় বেশি মনোযোগী। অসীম ক্ষমতার শিকড়ে সংবিধানসংলাপে অধ্যাপক আলী রীয়াজ ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, "রাষ্ট্রপতির অভাবনীয় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।" ফলে সংসদীয় পদ্ধতিতে হলেও বাস্তবে একক ব্যক্তি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।আকবর আলি খান তাঁর 'আবাক বাংলাদেশ' গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলেছেন,“বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ফ্রান্সের বুরবন সম্রাট, রাশিয়ার জার ও মোগল বাদশাহদের মতো।” সংবিধান কি প্রধানমন্ত্রীর হাতে খেলনা?সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত। তদুপরি, সংবিধান এবং অন্যান্য বিধিমালার মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী শুধু মন্
ত্রিসভার প্রধান নন, বরং মন্ত্রীদের অভিভাবক—এমন একক ক্ষমতার চিত্র সামনে এসেছে। দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে বিতর্কবর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে সরকারপ্রধান, সংসদ নেতা ও রাজনৈতিক দলের প্রধান—এ এককেন্দ্রিক অবস্থান গণতন্ত্রের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ। সংস্কার প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারবেন না। যদিও তা বাস্তবায়ন এখনও রাজনৈতিকভাবে দূরাশা। ৭০ অনুচ্ছেদ ও নিয়ন্ত্রণের শৃঙ্খলসংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ দিয়ে যেমন সাধারণ সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মত প্রকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি মন্ত্রীদেরও করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কৃপাধারী। ফলে, কোনো মন্ত্রীকে যেকোনো সময় বরখাস্ত করা বা যে কোনো মন্ত্রণালয় দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তেই সম্ভব। অতীত থেকে শিক্ষা২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় যখন নির্বাচনকালীন সরকারের জন্য আপস প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, তখনও বিরোধী দল বলেছিল,“প্রধানমন্ত্রীর হাতে তো সব ক্ষমতা—বাকি সবাই নিছক দর্শক।”পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারও একই ভুল করে বসে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে প্রধানমন্ত্রীর একক ইচ্ছায়, যেখানে দলের ভেতর ও বাইরের অনেকেই এর বিপক্ষে ছিলেন। গণতন্ত্র না ব্যক্তিতন্ত্র?গণতন্ত্র মানে একক শাসক নয়, বরং দলীয় ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ক্ষমতার ভারসাম্য।বর্তমান অবস্থা দেখে বোঝা যায়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতি কার্যত ‘প্রধানমন্ত্রী শাসিত’ ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে। যদি সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তাহলে রাজনীতি থেকে ব্যক্তি–নির্ভরতা সরিয়ে আনতে হবে।
মন্তব্য (০)