ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও তাঁর স্ত্রী ব্রিজিত মাখোঁর প্রেমকাহিনি নিয়ে শুরু থেকেই নানা জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনা চলেছে। তবে এ গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এটি বাস্তব, অথচ অবিশ্বাস্যভাবে বিরল।ফ্রান্সের রাজনীতিতে প্রেম, পরকীয়া ও বিতর্ক নতুন কিছু নয়। কিন্তু এমানুয়েল মাখোঁ একটি ব্যতিক্রম। কৈশোর বয়সেই তিনি যাঁর প্রেমে পড়েছিলেন, পরবর্তীতে তাকেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং আজও সেই সম্পর্কে অনুগত আছেন। এমন সম্পর্ক ফরাসি সমাজে একদিকে যেমন বিস্ময়, অন্যদিকে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।স্কুল ছাত্র ও শিক্ষিকার প্রেমমাখোঁ তখন কেবল ১৬ বছরের কিশোর, আর ব্রিজিতের বয়স ৪০। তাঁরা একসঙ্গে একটি নাট্যদলের কাজে যুক্ত হন। ব্রিজিত ছিলেন স্কুলের ফরাসি ভাষার শিক্ষিকা, আর মাখোঁ সেই স্কুলের মেধাবী ছাত্র। তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল আমিয়েঁ শহরের একটি ক্যাথলিক বেসরকারি স্কুলে।নাটক রচনার সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে গভীর সংযোগ তৈরি হয়। শহরের রক্ষণশীল সমাজ দ্রুত তাঁদের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে কানাঘুষা শুরু করে। এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের কাছেও বেনামি চিঠি আসতে থাকে।পরিবার ও সমাজের বিরোধিতামাখোঁর মা-বাবা স্পষ্টভাবে ব্রিজিতকে সম্পর্ক শেষ করতে বলেন। চাইলে তাঁরা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারতেন, কারণ ফরাসি আইন অনুযায়ী, কর্তৃত্বের অবস্থানে থাকা কেউ যদি নাবালকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান, সেটি অপরাধ। কিন্তু কোনো তদন্ত হয়নি, বরং মাখোঁকে প্যারিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সম্পর্কটি স্বাভাবিকভাবে মুছে যায়।কিন্তু মাখোঁ থামেননি। তিনি নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন এবং পরে সফলভাবে নিজের উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। অন্যদিকে ব্রিজিত তখনো বৈবাহিক জীবনে ছিলেন এবং তিন সন্তানের মা। তাঁর সেই সময়কার স্বামী, ব্যাংকার আন্দ্রে-লুই ওজিয়ের, দৃশ্যপট থেকে ধীরে ধীরে সরে যান।দশকের বেশি সময় ধরে আলাদা, তবুও একে অপরের প্রতি অনুগত২০০৬ সালে ব্রিজি
তের বিবাহবিচ্ছেদ হয়, আর এক বছর পর ২০০৭ সালে মাখোঁকে বিয়ে করেন। এত বছরের আলাদা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা দুজন একে অপরের প্রতি অনুগত ছিলেন। এই দীর্ঘ অপেক্ষা ও দৃঢ়তা তাঁদের সম্পর্ককে অনন্য করে তোলে।ফরাসি লেখিকা সিলভি বোমেল তাঁদের জীবনী নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, “তাঁদের সম্পর্ক রোমান্টিক গল্পের মতো শোনালেও এর পেছনে আছে সাহস, আত্মত্যাগ ও সামাজিক চাপের মুখে টিকে থাকার সংগ্রাম”।সামাজিক সমালোচনার কেন্দ্রে ব্রিজিতবয়সে ২৪ বছরের বড় একজন নারী ছোট এক ছেলেকে বিয়ে করেছেন, এ নিয়ে সমাজের একাংশ তাঁকে সমর্থন করলেও অনেকে সমালোচনাও করেছেন। ফরাসি সমাজে সাধারণত নারীরা নিজের চেয়ে বড় পুরুষকে বেছে নেন, সেখানে ব্রিজিত এই চিরাচরিত ধারা ভেঙেছেন।এমনকি আজও এলিসি প্রাসাদে পাঠানো চিঠিতে তাঁর নামে কটূক্তি লেখা হয়। অনেকেই বলেন, এ দম্পতি আদৌ একসঙ্গে থাকেন না, বা তাঁদের সম্পর্ক বিকৃত। কেউ কেউ মাখোঁকে সমকামী বলেও গুজব ছড়ান।গুজব বনাম বাস্তবতাবোমেলের মতে, এমন কোনো প্রমাণ নেই যে মাখোঁ গোপনে সমকামী, বা তাঁর যৌন জীবনে বিচ্যুতি আছে। বরং তিনি মনে করেন, ফ্রান্সের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রেসিডেন্ট আছেন, যিনি স্থিতিশীল ও দৃঢ় দাম্পত্য জীবনে আছেন।তিনি বলেন, “যে কোনো বড় দায়িত্বশীল কাজের পেছনে একটি সুশৃঙ্খল পারিবারিক জীবনের প্রভাব থাকে, মাখোঁ সেই ব্যতিক্রম নন”। অনেকের চোখে তিনি “অ্যান্টি-ডমিনিক স্ট্রস-কান” — যিনি আইএমএফপ্রধান থাকা অবস্থায় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।শেষ কথা মাখোঁ ও ব্রিজিতের প্রেম কেবল বয়সের পার্থক্য নিয়ে নয়, বরং সামাজিক বাধা ও ব্যক্তিগত সংগ্রাম অতিক্রম করে ভালোবাসার জয়ে পৌঁছানো এক বিরল উদাহরণ। হয়তো এ সম্পর্ককে সবাই মেনে নিতে পারেন না, কিন্তু তাঁদের ১০ বছরের দূরত্বেও একে অপরের প্রতি নিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবেই।
মন্তব্য (০)