মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগনের সর্বশেষ গোয়েন্দা মূল্যায়নে উঠে এসেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অন্তত এক থেকে দুই বছর পিছিয়ে গেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন যে, “ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে”, তবে পেন্টাগনের এই মূল্যায়ন তাঁর বক্তব্যকে পুরোপুরি সমর্থন করছে না।পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পারনেল গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, “আমাদের হামলায় ইরানের তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা অন্তত এক-দুই বছরের জন্য পিছিয়ে গেছে। এটি একটি সাহসী অভিযান ছিল।”গত ২১ জুন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমানের মাধ্যমে এই আঘাত হানা হয়। হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত স্থাপনাগুলো, যার মধ্যে অন্যতম ফর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র।হামলায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিয়ে বিভক্ত মূল্যায়নট্রাম্প প্রশাসন যেখানে বারবার বলে এসেছে “ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা হয়েছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন”, সেখানে প্রাথমিক গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইরানের মূল পারমাণবিক প্রযুক্তি ও উপাদানগুলো অনেকটাই অক্ষত রয়ে গেছে। ফলে প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হয়ে সাময়িক বিলম্বিত হয়েছে।ইরানও বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। কিছু কর্মকর্তা আংশিক ক্ষতির কথা স্বীকার করলেও আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি এই হামলার প্রভাবকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন।হামলার আগে ও পরে সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডস্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হামলার ঠিক আগ মুহূর্তে ফর্দো স্থাপনা থেকে কিছু ট্রাক বেরিয়ে যেতে দেখা গেছে, যা ইঙ্গিত দেয়, গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো সরিয়ে ফেলা হতে পারে।জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জানিয়েছেন, “ইউরেনিয়াম সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত কিছু কনটেইনার হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না”। তিনি বলেন, “কিছু হয়তো ধ্বংস হয়েছে, আবার কিছু হয়তো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে”।এছাড়া গ্রোসি সতর্ক করে বলেন, “ইরান আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করতে
পারে”, যা পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেছে ইরানহামলার পর ইরান আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে। ইরানি পার্লামেন্ট একটি আইন পাস করে জানায়, আইএইএ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, তাই সংস্থাটির সঙ্গে আর কাজ করবে না। এর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের বাইরে চলে গেছে, যা আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে বাড়িয়ে তুলেছে।আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও বিতর্কজেনেভা কনভেনশনের আওতায় যেসব স্থাপনায় বিপজ্জনক শক্তি রয়েছে, সেগুলোতে হামলা নিষিদ্ধ, কিন্তু তবুও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি ছিল, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে রয়েছে, তবে তেহরান বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।সংঘাতে বেসামরিক প্রাণহানি ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াইসরায়েলি হামলায় শত শত ইরানি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে পরমাণু বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারবর্গ। ইরানও জবাবে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালায়, যাতে ২৯ জন নিহত হয়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালালে, ইরানও পাল্টা জবাবে কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, যদিও তাতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।শেষপর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন এবং উভয় দেশই নিজেদের পক্ষ থেকে এই সংঘর্ষকে “ঐতিহাসিক বিজয়” হিসেবে ঘোষণা করে।উপসংহারএই ঘটনা প্রমাণ করে যে, পারমাণবিক কর্মসূচি ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কতটা উত্তপ্ত ও জটিল হতে পারে। পেন্টাগনের মূল্যায়নে ইরানের প্রকল্প ধ্বংস না হয়ে বরং সাময়িকভাবে থমকে গেছে বলে দেখা গেলেও, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের অনুপস্থিতি বিশ্বকে উদ্বেগের নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে মধ্যস্থতা করে ইরানকে আইএইএর সঙ্গে পুনরায় সহযোগিতায় ফিরিয়ে আনা, যাতে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর কার্যক্রম স্বচ্ছতা বজায় রেখে পরিচালিত হয়।
মন্তব্য (০)