বিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী মহাকাশযান ভয়েজার ১-এর বহু বছর ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা থ্রাস্টারগুলো আবার চালু করতে সক্ষম হয়েছে নাসার ইঞ্জিনিয়াররা। এ ঘটনা ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন একটি বড় ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা শুরু হওয়ার ঠিক আগেই মহাকাশযানটির বেঁচে থাকা নির্ভর করছিল এই থ্রাস্টারগুলোর উপর।নাসার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পৃথিবীর একটি বিশাল এন্টেনার (অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অবস্থিত) উন্নয়ন কাজ চলার কারণে ভয়েজার ১ এবং ২-এর সাথে যোগাযোগে দীর্ঘ বিরতি আসতে যাচ্ছে। এই সময়ে যদি মহাকাশযানটির থ্রাস্টার বিকল হয়ে যেত, তাহলে সেটিকে পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো উপায় থাকতো না। দীর্ঘদিন পর চালু হল মূল রোল থ্রাস্টারভয়েজার ১ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এই যানটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৫ বিলিয়ন কিলোমিটার (১৫.
৫ বিলিয়ন মাইল) দূরে অবস্থান করছে এখন, এবং এটি ইন্টারস্টেলার স্পেসে প্রবেশ করা প্রথম মানব-নির্মিত বস্তু। সঠিকভাবে পৃথিবীর দিকে অ্যান্টেনা নির্দেশিত রাখতে মহাকাশযানটি একাধিক থ্রাস্টার ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে রয়েছে রোল থ্রাস্টার — যা গাইড স্টারের দিকে মহাকাশযানটির অবস্থান নির্ধারণ করে রাখতে সাহায্য করে।কিন্তু ২০০৪ সালে এই মূল রোল থ্রাস্টারগুলোর হিটার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়, এবং তখন থেকে মহাকাশযানটি ব্যাকআপ রোল থ্রাস্টার ব্যবহার করছিল। এই ব্যাকআপ থ্রাস্টারগুলো বহু বছর চমৎকারভাবে কাজ করলেও, সম্প্রতি জ্বালানির অবশিষ্টাংশ জমে যাওয়ায় সেগুলোরও বিকল হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। থ্রাস্টার মেরামতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপদীর্ঘ বিশ্লেষণ শেষে নাসার প্রকৌশলীরা বুঝতে পারেন, একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ সংক্রান্ত সুইচ ভুলভাবে সরে গিয়েছিল, যার ফলে হিটারগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা সিদ্ধান্ত নেন, পুরনো থ্রাস্টারগুলোকেই আবার সক্রিয় করার চেষ্টা করা হবে — যদিও এতে ছিল বিপদের সম্ভাবনা। কারণ, গাইড স্টার থেকে দূরে সরে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোল থ্রাস্টার চালু হয়ে যেতে পারে, আর তখন যদি হিটার গরম না হয়, তবে ছোটখাটো বিস্ফোরণের আশঙ্কা ছিল।তারপরও নাসা দল ঝুঁকি নেয় এবং ২০২৫ সালের মার্চের ২০ তারিখ মহাকাশযানটিতে কমান্ড পাঠানো হয়। ২৩ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে যখন তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার তথ্য ফিরে আসে, তখনই জানা যায় থ্রাস্টার হিটারগুলো কাজ করছে — অর্থাৎ প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়এমন একটি সাহসী উদ্যোগের পেছনে বড় কারণ ছিল ক্যানবেরা এন্টেনার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অফলাইনে যাওয়া। এই সময়ে শুধু আগস্ট ও ডিসেম্বরে সাময়িকভাবে এটি চালু থাকবে। ফলে থ্রাস্টার পরীক্ষা করে নেওয়ার এই সময়টি ছিল একমাত্র সুযোগ। পরীক্ষাটি সফল হওয়ায় এখন আগস্টে থ্রাস্টার চালুর প্রয়োজন হলে নিশ্চিত থাকা যাবে সেগুলো কাজ করবে। এক অলৌকিক সাফল্যনাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির প্রকৌশলী টড বারবার বলেন, “এই থ্রাস্টারগুলো অনেক বছর ধরেই মৃত হিসেবে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের এক ইঞ্জিনিয়ারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে সবকিছু। এটা ছিল আরেকটি অলৌকিক বাঁচানো অভিযান — ভয়েজারের জন্য আরেকটি জীবন্ত মুহূর্ত।”এই ঐতিহাসিক সাফল্য শুধু একটি যন্ত্রের নয়, এটি মানুষের চরম ধৈর্য, প্রযুক্তি জ্ঞান ও সৃষ্টিশীলতার জয়গাথা। মহাকাশের গভীরে পাড়ি দিয়ে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে তথ্য পাঠানো ভয়েজার ১ এখনও তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে — আর তার পেছনে কাজ করছে একটি অদম্য দল। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্বে নাসার এ ধরনের সাফল্য ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানে এক উজ্জ্বল দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
মন্তব্য (০)