পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে থাকা এক বিশাল সোনার ভাণ্ডার থেকে ধীরে ধীরে উপরের স্তরের দিকে মূল্যবান ধাতু নির্গত হচ্ছে — এবং সেই ধাতব পদার্থগুলো আগ্নেয় দ্বীপের (যেমন হাওয়াই) গঠনকালীন সময়ে ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছাচ্ছে বলে এক নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে।এই তত্ত্বটি এসেছে হাওয়াইয়ের আগ্নেয় শিলার উপর তিন বছরের গবেষণা ও বিশ্লেষণ থেকে। এই আগ্নেয় শিলাগুলি সমুদ্রতলের নিচ থেকে উঠে আসা ম্যাগমার বিস্ফোরণের ফলেই তৈরি হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এই শিলায় পাওয়া ভারী ধাতব উপাদানগুলো প্রমাণ করে যে পৃথিবীর গলিত কেন্দ্র আর পুরোপুরি আলাদা নয় বরং মাঝে মাঝেই তা পাথুরে আবরণ বা ম্যান্টলের সঙ্গে মিশছে।"প্রায় ৪০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেছিলেন যে, পৃথিবীর কেন্দ্র কিছু পরিমাণ পদার্থ হারাচ্ছে, কিন্তু এতদিন এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি," বলেন জার্মানির গটিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ নিলস ম্যাসলিং, যিনি গবেষণার প্রধান লেখক। "এখন আমাদের হাতে আছে এক শক্তিশালী প্রমাণ – পৃথিবীর কেন্দ্রের কিছু অংশ সত্যিই ম্যান্টলে চলে যাচ্ছে।"বিশেষজ্ঞদের ধারণা, পৃথিবীর মোট সোনার ৯৯.৯৫ শতাংশই কেন্দ্রস্থলের ভেতর গলিত অবস্থায় রয়েছে। এই সোনা এবং প্ল্যাটিনামের মতো অন্যান্য মূল্যবান ধাতুগুলো সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ৪.
৫ বিলিয়ন বছর আগে, যখন পৃথিবী গঠনের প্রাথমিক ধাপে উল্কাবৃষ্টির মাধ্যমে এই ধাতুগুলো জমা হয়।কিন্তু এই গবেষণা বলছে, সেই সোনার কিছু অংশ ধীরে ধীরে ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসছে, এবং ভবিষ্যতে আরও সোনা উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।"হাওয়াইয়ের মতো দ্বীপের উৎপত্তি এই ম্যান্টল-প্লুম থেকে হওয়া উত্তপ্ত পাথরের মাধ্যমে হয়, এবং এটি পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে উঠে আসে," বলছেন গবেষণার সহলেখক অধ্যাপক ম্যাথিয়াস উইলবল্ড।পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে মূল্যবান ধাতু অনুসন্ধানের পেছনের গল্পগবেষকরা হাওয়াইয়ের আগ্নেয় শিলার নমুনা সংগ্রহ করেন যুক্তরাষ্ট্রের Smithsonian Institution থেকে। সেগুলোর বেশিরভাগই দেখতে সাধারণ — কালচে বাসাল্ট শিলা। এই শিলাগুলো গুঁড়ো করে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় গলিয়ে তরল নমুনা তৈরি করা হয়।তারপর তারা Platinum Group Elements (PGE) – যেমন রুথেনিয়াম, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, ইরিডিয়াম ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেন। বিশেষ করে রুথেনিয়াম-এর প্রতি জোর দেওয়া হয়, কারণ এটি সোনার মতোই ভূ-পৃষ্ঠে অত্যন্ত দুর্লভ।"ম্যান্টলে রুথেনিয়াম প্রায় নেই বললেই চলে," বলেন ম্যাসলিং। "এই ধাতু উল্কা থেকে এসেছিল এবং তখনকার সব রুথেনিয়াম গলে গিয়ে কেন্দ্রস্থলে চলে যায়। তাই যদি এখন এই ধাতু পাওয়া যায়, সেটা প্রমাণ করে এটি কেন্দ্র থেকেই এসেছে।"তারা একটি নির্দিষ্ট রুথেনিয়াম আইসোটোপ চিহ্নিত করেন, যা শুধুমাত্র পৃথিবী গঠনের শুরুর দিকের উপাদানে পাওয়া যায় — অর্থাৎ আজকের উল্কা বা অন্য কোথাও নয়। এটি দেখে গবেষকরা নিশ্চিত হন, এই ধাতুর উৎস পৃথিবীর গলিত কেন্দ্র।গোল্ড ও রুথেনিয়ামের সম্পর্কম্যাসলিং বলেন, রুথেনিয়াম ও সোনা রসায়নগতভাবে একে অপরের সঙ্গে মিল আছে। তাই যদি রুথেনিয়াম নির্গত হয়, তাহলে সোনাও একইভাবে নির্গত হচ্ছে। যদিও পরিমাণে এটি অত্যন্ত সামান্য — প্রতি আধা কেজি শিলায় মিলিগ্রামেরও কম।কিন্তু সমস্যা হলো, পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এই সোনা আহরণ করা আজকের প্রযুক্তিতে অসম্ভব। পৃথিবীর কেন্দ্র প্রায় ২,৯০০ কিলোমিটার গভীরে, যেখানে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে গভীর খনন ছিল মাত্র ১২.৩ কিলোমিটার (Kola Superdeep Borehole, রাশিয়া)।বিজ্ঞানীদের চোখে নতুন সম্ভাবনার দ্বার"পৃথিবীর কেন্দ্র এবং ম্যান্টল আসলে একে অপরের সঙ্গে মেশে না, কারণ তাদের ঘনত্ব একেবারে আলাদা। তাই এটি যেন তেল আর পানির মতো মিশে না যাওয়ার কথা," বলেন ম্যাসলিং। "তবুও, কিছু একটা ঘটছে যেটা আমরা এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।"গবেষকরা মনে করছেন, এই ধাতু নির্গমনের প্রক্রিয়াটি প্রায় ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি বছর ধরে ঘটছে, এবং আজও সম্ভবত এই প্রক্রিয়া চলমান।"এই ঘটনা যদি বিলিয়ন বছরের হিসেব ধরে দেখা হয়, তাহলে এটি পৃথিবীর গঠনেই পরিবর্তন আনতে পারে," বলেন ম্যাসলিং।বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়াবিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।"এটি একটি উত্তেজনাপূর্ণ আবিষ্কার। এটি নিশ্চিত করে যে, হাওয়াইয়ের মতো আগ্নেয় দ্বীপের উৎপত্তির জন্য ব্যবহৃত ম্যান্টল-প্লুমে কিছু উপাদান সত্যিই পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে এসেছে," বলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলেন উইলিয়ামস।পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেসি রেইমিঙ্ক বলেন, "এটি অনেক পুরনো বিতর্ক, কিন্তু এই গবেষণাটি নিশ্চিতভাবে বলছে — পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে ধাতব উপাদান বেরিয়ে আসছে।" সারাংশে: পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে নির্গত হচ্ছে মূল্যবান ধাতু!হাওয়াইয়ের আগ্নেয় শিলায় পাওয়া রুথেনিয়াম প্রমাণ করছে পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে ধাতু বেরিয়ে আসছে।এর অর্থ, ভবিষ্যতে সোনার সরবরাহ ধীরে ধীরে বাড়তে পারে — যদিও পরিমাণে তা খুবই সামান্য।এটি পৃথিবীর অভ্যন্তরের গঠন ও বিকাশ সম্পর্কে নতুন আলো ফেলছে।
মন্তব্য (০)