মূল্যস্ফীতি কী?মূল্যস্ফীতি বলতে বোঝায়—সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবার দাম বাড়া, যার ফলে টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ, আগের মতো একই টাকায় এখন আপনি আগের মতো কিছুই কিনতে পারবেন না। গত ২–৩ বছর ধরে চাল, দুধ, ডিম, সবজিসহ সবকিছুতে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর তাই পকেটে থাকা টাকা কম কার্যকর হয়ে পড়ছে।মূল্যস্ফীতি কেন হয়?মূল্যস্ফীতি মূলত পাঁচ ধরনের মাধ্যমে ঘটে, চলুন খুঁটিয়ে বুঝি:১. চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতি (Demand‑Pull)যখন চাহিদা বেশি কিন্তু সরবরাহ কম, তখন দাম বাড়ে। উদাহরণ: বন্যা বা দুর্ভোগের কারণে চালের সরবরাহ কমে যায়, ফলে দাম ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকায় চলে যায়।২. ব্যয়‑চালিত মূল্যস্ফীতি (Cost‑Push)যখন উৎপাদন বা কাঁচামালের খরচ বাড়ে, পণ্য ভীড়ে দাম বাড়ে। যেমন: চালের দাম বাড়লে মুড়ি বিক্রেতা খরচ ঢাকতে দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকার পরিবর্তে ৩৫ টাকায় বিক্রি শুরু করে।৩. অন্তর্নিহিত মূল্যস্ফীতি (Built‑In)মূল্যবৃদ্ধি শুরু হলে মূল্যবৃদ্ধি আরচির মতো কাজ করে—কর্মীরা বেতন বাড়ি দাবি করে, উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, দাম বাড়ে—একটি 'মূল্য-বেতন চক্র' তৈরি হয়।৪. অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ (Monetary Expansion)যখন বাজারে টাকার পরিমাণ বেড়ে যায়, মানুষ হাতে বেশি টাকা নিয়ে বেশি জিনিস কিনতে চায়, কিন্তু জিনিস ততটাই আছে, তখন দাম বাড়ে।৫. মজুরি‑বর্ধিত মূল্যস্ফীতি (Wage‑Push)কর্মীদের বেতন বাড়লে উৎপাদনের খরচ বাড়ে, আর তা পণ্যে যুক্ত হলে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। তবে যদি উত্পাদনও বেড়ে, তবে এই সমস্যা কিছুটা কমে যায়।মূল্যস্ফীতি কী‑ভাবে পরিমাপ করা হয়?সরকার প্রধানত ব্যবহার করে ভোক্তা মূল্যসূচক (CPI)। এতে একটি বেন্ড তৈরি হয়—রুটি, দুধ, ডিম, পরিবহন ইত্যাদি—যে দ্রব্যগুলো একসঙ্গে গড় করে দেখানো হয়।উদাহরণ হিসেবে: ২০২৪: রুটি ৩০, দুধ ৪০, ডিম ৫০, মোমবাতি ১০, সিনেমা ৫০ → মোট ১৮০ টাকা ২০২৫: রুটি ৩২, দুধ ৪২, ডিম ৫৫, মোমবাতি ১২, সিনেমা ৫৫ → মোট ২০৭ টাকা → এক বছরে দাম বেড়েছে ৮.
৮৯%, তাই CPI ≈ ৮.৯% তবে সেটি সবকিছু নিখুঁতভাবে অঙ্কে আনে না—প্রাথমিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বেশি বাড়লে মানুষ ‘দাম বাড়ে’ বলে মনে করবে।মূল্যস্ফীতি কি সব সময় খারাপ?নিচে দেখি দিক‑দুটি:মৃদু মূল্যস্ফীতি (২‑৩%) অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে স্বীকৃতি দেয়, কারণ এটি অর্থনৈতিক সচলতা বজায় রাখে। মানুষ ভবিষ্যতে দাম বাড়বে বুঝেই এখনই বেশি খরচ/বিনিয়োগ করে, ফলে অর্থনীতি এগিয়ে যায়।ডিফ্লেশন (ঋণাত্মক মূল্যস্ফীতি) দাম কমে গেলে, মানুষ বেশি খরচ না করে, কোম্পানি বেতন‑কাটে, অর্থনীতি ভেঙে পড়ে—যেমন ১৯৩০ সালের মহামন্দা। হাইপারইনফ্লেশন মাসে ৫০%‑এর বেশি দাম বাড়ে—ভেনেজুয়েলা, জিম্বাবুয়ে, হাঙ্গেরি‑তে এর ভয়াবহ পরিণতি দেখা গেছে।মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কীভাবে কাজ হয়?মূলভাবে দায়িত্বে আছেন—কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Monetary Policy) সুদের হার বাড়িয়ে বা কমিয়ে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ওপেন‑মার্কেট বন্ড ক্রয়/বিক্রয় করে বাজারে টাকা ঢালা বা টানা সরকার (Fiscal Policy) কর নির্ধারণ: কর বাড়াতে খরচ কমে, মূল্যস্ফীতি কমে সরকারি ব্যয়: প্রকল্প বাড়লে খরচ বাড়ে—মূল্যস্ফীতি বাড়ে; প্রকল্প কমলে দাম কমে নিজেকে মূল্যস্ফীতি থেকে কিভাবে রক্ষা করবেন? টাকা না রেখে, ইনভেস্ট করুন—যেমন: সোনা, স্টক, রিয়েল এস্টেট, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি ফিক্সড ডিপোজিট বা ব্যাংক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে লাভ না হলেও টাকা মূল্য কমে না সংক্ষেপে মূল্যস্ফীতি হলো অর্থনীতির একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অংশ। যদি তা অত্যধিক না হয়, তবে অল্প মূল্যস্ফীতিই অর্থনীতিকে সচল রাখে। তবে হাইপারইনফ্লেশন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দায়িত্বপ্রাপ্ত—কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার। আপনিও নিজেকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রস্তুত করে রাখতে পারেন—বিনিয়োগ, সঞ্চয় এবং খরচ পরিকল্পনার মাধ্যমে।
মন্তব্য (০)