২০২৫ সালের পর ২০৩৫ সালের মধ্যেই ন্যাটোর সদস্যদেশগুলো তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোটের নতুন মহাসচিব মার্ক রুত্তে একে বলেছেন “বিস্ময়কর অগ্রগতি”, যা নাকি ১০০ কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষায় সহায়ক হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি আসলে সামরিক উত্তেজনা বাড়ানোরই প্রস্তুতি।২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে বাজেট বৃদ্ধির পেছনে কী হিসাব?ন্যাটো ২০০২ সালে প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ২% ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, কিন্তু বহু দেশই তখন তা পূরণ করতে পারেনি। ২০২১ সালেও মাত্র ৬টি দেশ এই টার্গেট পূরণ করেছিল, অথচ এখন ২৩টি দেশ ২% লক্ষ্যে পৌঁছেছে, এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ৩২টি দেশ এই সীমা ছুঁবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন জোট বলছে, আগামী দশকে সেই লক্ষ্য দ্বিগুণ করে জিডিপির ৫% পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এই ঘোষণার পেছনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে খুশি করার চাপ এবং অস্ত্র শিল্পের লবিংয়ের প্রভাব। সেই ৫% খরচের মধ্যে ১% রাখা হয়েছে সামরিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য, এমনকি বেসামরিক খাতের কিছু খরচকেও এতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।কত টাকা খরচ হবে এই সিদ্ধান্তে?গত বছরই ন্যাটো সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট সামরিক ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যয় দাঁড়াবে আনুমানিক ১৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার। এই বিপুল অর্থ দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে এককালীন ১,৬৭৪ ডলার করে সহায়তা দেওয়া যেত। কী কাটছে, কোথা থেকে আসছে অর্থ?এই অর্থ তুলে আনতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশ খাত। ইউরোপে ইতিমধ্যেই ৩০% মানুষ মাস শেষে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন। জলবায়ুবিদরা সতর্ক করছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.
৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমায় রাখতে হাতে আছে মাত্র দুই বছর।স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এই ব্যয়ের বিরোধিতা করে বলেন, “৫% ব্যয়ের লক্ষ্যে যেতে হলে ২০৩৫ সালের মধ্যে স্পেনকে অতিরিক্ত ৩০০ বিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হতো। এই টাকা আসবে কোথা থেকে? স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় কাটছাঁট করে?” আসল শত্রু কে?ন্যাটো দাবি করছে, এই খরচের পেছনে রয়েছে ‘রাশিয়া’ ও ‘সন্ত্রাসবাদ’ মোকাবেলার যৌক্তিকতা। কিন্তু রাশিয়ার বর্তমান সামরিক বাজেট ও অর্থনীতির তুলনায় ন্যাটো অনেক এগিয়ে। রাশিয়ার জিডিপি মাত্র ২ ট্রিলিয়ন ডলার ন্যাটো দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি (যুক্তরাষ্ট্র বাদে) ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রের একার জিডিপি ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার এই বাস্তবতায় রাশিয়া কখনোই সামরিকভাবে ন্যাটোর ৩২ দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ব্যয় কার্যকর?ইতিহাস বলে, ন্যাটোর আগের সামরিক হস্তক্ষেপগুলো—যেমন আফগানিস্তান ও লিবিয়ায়—অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে প্রমাণ মেলে যে, বড় ব্যয় মানেই কার্যকর নিরাপত্তা নয়।কারা লাভবান?বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ন্যাটোর এই ‘নিরাপত্তা উদ্যোগ’ আসলে অস্ত্র কোম্পানিগুলোর জন্য সুবর্ণ সুযোগ। ট্রাম্পের চাপ আসার আগেই ইউরোপে লবিং গ্রুপগুলো সামরিক খরচ বাড়াতে কার্যকর প্রচার চালিয়েছে। এখন সেই অস্ত্র কোম্পানিগুলো নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ, ন্যাটোর নিরাপত্তা মানে আসলে যুদ্ধ ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা। শেষ কথান্যাটোর এই ৫% বাজেট সিদ্ধান্ত শুধু একটি সামরিক পরিকল্পনা নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নও। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সংকট চলছে, সেখানে অস্ত্রে বিনিয়োগ কি সত্যিই মানবজাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরই দিতে হবে—আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবো, নাকি শান্তির জন্য লড়ব?
মন্তব্য (০)