একটি শিশুর বড় হয়ে ওঠার গল্পে প্রতিদিনের মতোই থাকে এক গ্লাস দুধ—সুস্থতা, পুষ্টি ও জীবনীশক্তির প্রতীক হিসেবে। আর সেই গুরুত্বকেই তুলে ধরতেই প্রতিবছর ১ জুন বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় 'বিশ্ব দুগ্ধ দিবস'।এই দিবসটি প্রথম চালু করে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০০১ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য, মানুষের মাঝে দুধের পুষ্টিগুণ ও এর সামাজিক–অর্থনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা। এবারের (২০২৫) প্রতিপাদ্য "আসুন উদ্যাপন করি দুগ্ধের শক্তি", যা বর্তমান সময়ের জন্য খুবই যথার্থ।দুধকে বলা হয় একটি 'সম্পূর্ণ খাদ্য'। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও বি১২, ফসফরাসসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। এসব উপাদান শিশুদের হাড় ও দাঁতের গঠনে, বয়স্কদের হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত দুধ পান করলে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও কিছু ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই দুধ খাওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। কেউ বলেন এতে ওজন বাড়ে, কেউ বলেন ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চর্বি কমানো বা স্কিমড দুধ পরিমিত পরিমাণে খেলে তা প্রায় সকলের জন্যই উপকারী।এমনকি ডায়াবেটিস রোগীরাও প্রতিদিন এক–দুই গ্লাস দুধ পান করে উপকার পেতে পারেন। একটি আকর্ষণীয় তথ্য হচ্ছে, ‘মিল্ক ফ্যাট প্যারাডক্স’—যেখানে দেখা গেছে, দুধে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকলেও তা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। কারণ দুধে থাকা শর্ট ও মিডিয়াম চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের জন্য ভিন্নভাবে কাজ করে।বাংলাদেশে প্রতিদিন লাখ লাখ লিটার
দুধ উৎপাদিত হচ্ছে হাজার হাজার ছোট খামার থেকে। এর মাধ্যমে লক্ষাধিক কৃষক, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা, তাদের পরিবার চালাচ্ছেন। দুধ শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা নয়, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং পরিবারের পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।বিশ্বের অনেক দেশে ‘স্কুল মিল্ক প্রোগ্রাম’ চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ দেওয়া হয়। এটি শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে আরও সুস্থ ও মেধাবী।এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুধ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা, মানসম্মত পশু খাদ্য ও পশু চিকিৎসা—এইসব উদ্যোগ টেকসই ও পরিবেশবান্ধব দুগ্ধ শিল্প গড়তে সহায়ক হতে পারে। ইতোমধ্যেই সরকারি ও বেসরকারি খাতে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।বিশ্ব দুগ্ধ দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—দুধ শুধু একটি খাবার নয়, এটি সুস্থ জীবনের অংশ। এই দিনটি উদ্যাপন করতে গিয়ে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই দুধ উৎপাদনে যুক্ত কৃষক ও প্রাণিকল্যাণে নিয়োজিত সকলের প্রতি।আজকের দিনে শুধু দুধ পান করার কথা নয়, বরং একটি সচেতন ও স্বাস্থ্যবান সমাজ গঠনের আহ্বানও। কারণ দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন ও পরিবেশ—সবকিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লেখক: ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স), পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য (০)