যদি মৌমাছি হারিয়ে যায়, তবে মানবসভ্যতার অস্তিত্বও টিকে থাকবে না—এটা শুধু একটি সতর্কবার্তা নয়, বরং বাস্তব বিজ্ঞানভিত্তিক সত্যানুভব। ক্ষুদ্র অথচ অপরিহার্য এই পতঙ্গটি বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এক অপরিসীম অবদান রেখে চলেছে। বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব মৌমাছি দিবস'জাতিসংঘ ২০১৮ সাল থেকে ২০ মে তারিখকে ঘোষণা করেছে ‘বিশ্ব মৌমাছি দিবস’ হিসেবে। এই দিনটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো—মানবসভ্যতা যেন মৌমাছির গুরুত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয় এবং এদের টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এগিয়ে আসে। ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানো এক শ্রমিকএকটি সাধারণ শ্রমিক মৌমাছিকে মাত্র এক ফোঁটা মধু সংগ্রহ করতে ঘুরতে হয় প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০টি ফুলে। তারা শুধুমাত্র মধু উৎপাদনই করে না, বরং পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবৃদ্ধি নিশ্চিত করে।৯০% বন্য ফুল, ৭৫% কৃষিজ ফসল এবং ৩৫% বৈশ্বিক কৃষি মৌমাছির পরাগায়নের ওপর নির্ভর করে।বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, “যদি পৃথিবী থেকে মৌমাছি হারিয়ে যায়, তাহলে মানুষ আরও চার বছরের বেশি বাঁচবে না।” এই বক্তব্য আজকের বাস্তবতায় ভয়াবহ রকম প্রাসঙ্গিক। সুন্দরবন ও মৌমাছি: এক নিবিড় সম্পর্কদক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবিকা, কৃষি ও জীববৈচিত্র্য অনেকটাই নির্ভর করে সুন্দরবনের অস্তিত্বের ওপর। আর সুন্দরবনের টিকে থাকার পেছনে মৌমাছির ভূমিকা অনস্বীকার্য।পরাগায়নের মাধ্যমে গাছের বংশবৃদ্ধিতে মৌমাছি যে অবদান রাখে, তা না থাকলে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ অরণ্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে।সুন্দরব
নের বর্তমান মৌসুমে বিভিন্ন গাছে ফুল ফুটে রয়েছে এবং গাছে গাছে ঝুলছে অসংখ্য মৌচাক। ফরেস্ট অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান, এই মৌসুম সুন্দরবনের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যকে করেছে আরও বর্ণিল। সুন্দরবনে বাস করা মৌমাছির জাতচট্টগ্রামের আলওয়ান মধু গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ মুহাম্মদ মঈনুল আনোয়ার জানান, বাংলাদেশে প্রধানত ৫ প্রজাতির মৌমাছি দেখা যায়, তবে সুন্দরবনে সাধারণত “অ্যাপিস ডরসেটা” ও “স্ট্রিং-লেস” জাতের মৌমাছি বেশি পাওয়া যায়। অ্যাপিস ডরসেটা: তুলনামূলক বড় আকৃতির ও কিছুটা আক্রমণাত্মক। চৈত্র-বৈশাখে সুন্দরবনে আসে, ২-২.৫ মাস অবস্থান করে। স্ট্রিং-লেস মৌমাছি: ছোট আকৃতির, গাছের গর্তে বাসা তৈরি করে। এদের মৌচাক গোলাকৃতির এবং মধুর পরিমাণ কম হলেও গুণগত মান অনেক বেশি। কৃষিতে মৌমাছির অবদানগাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. রুহুল আমীন বলেন, “একটি মৌচাকের সব মৌমাছি মিলে বছরে প্রায় চার বিলিয়ন ফুলে পরাগায়ন ঘটাতে পারে।”একটি কর্মী মৌমাছি তার জীবদ্দশায় প্রায় ৭০০ হেক্টর ফসলি জমিতে বিচরণ করতে পারে। পরাগায়নের ফলে শুধু ফসলের পরিমাণই নয়, ফল ও বীজের গুণগত মানও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।মৌমাছি শুধু মধু দেয় না, দেয় জীবন রক্ষার উপকরণ। খাদ্য উৎপাদন, পরিবেশের ভারসাম্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের পুনর্জন্ম—সব কিছুতে মৌমাছির প্রতিক্রিয়া আশ্চর্যজনক। আজকের দিনে মৌমাছিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া মানেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেওয়া।
মন্তব্য (০)