২০২৩ সালের ৯ মে পাকিস্তানের ইতিহাসে এক বেদনাদায়ক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়, যেখানে সেনাবাহিনী ও সরকারি স্থাপনাগুলো ছিল মূল টার্গেট। কিন্তু ঠিক দুই বছর পর, ২০২৫ সালের ১১ মে, পাকিস্তান যেন এক সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখল—হাজারো মানুষ রাস্তায় নামলেন সেনাবাহিনীর সমর্থনে।সংঘর্ষে সেনাবাহিনী হয়ে উঠল জাতীয় প্রতিরক্ষার প্রতীকগত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘটে যাওয়া সীমান্ত সংঘর্ষ দেশটির জনমনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সংঘর্ষে সেনাবাহিনীকে দেশের রক্ষক হিসেবে দেখা হয়েছে। গ্যালাপ পাকিস্তানের জরিপ অনুযায়ী, ৯৬% অংশগ্রহণকারী মনে করেন পাকিস্তান জয়ী হয়েছে, এবং ৮২% সেনাবাহিনীর পারফরম্যান্সকে ‘অত্যন্ত ভালো’ বলেছে।সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হলো, ৯২% নাগরিকের মতে, এই সংঘর্ষ সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করেছে।‘কালো দিবস’ থেকে ‘ন্যায়সঙ্গত বিজয় দিবস’-এ রূপান্তর২০২৫ সালের ১০ মে দিনটি সরকারিভাবে ‘ন্যায্য যুদ্ধের দিন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে ২০২৩ সালের ৯ মে ছিল ‘কালো দিবস’। একমাত্রিকভাবে সেনাবাহিনীর দমনমূলক ভাবমূর্তি এবার রূপ নিয়েছে বীরত্বপূর্ণ রক্ষক হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, "এটি শুধু একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির বিজয়"।তিনি পাকিস্তানের অভিযানের নাম দিয়েছেন ‘বুনইয়ান মারসুস’, যার অর্থ ‘সুদৃঢ় সিসার প্রাচীর’, যা কোরআনের সূরা আস-সাফ থেকে নেওয়া।ইমরান খানের অবস্থান: পরিবর্তনের ইঙ্গিতকারাগারে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তাঁর আইনজীবীদের মাধ
্যমে পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, "জনগণের মনোবলই সেনাবাহিনীর মূল শক্তি।"সেনাবাহিনী: শ্রদ্ধা নাকি ভয়?সেনাবাহিনী পাকিস্তানে দীর্ঘকাল ধরে সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। তবে, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইমরান খানের উত্থান ও পতনের সময় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৩ সালের ৯ মে-র দাঙ্গা ছিল সেই ক্ষোভের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যা পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর ব্যাপক দমননীতিতে রূপ নেয়।তবে এবার সংঘর্ষের পর সেনাবাহিনী যে ‘জনতার নায়ক’ হয়ে উঠেছে, তা এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে।সীমান্ত সংঘর্ষ ও জাতীয়তা বোধভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব, বিশেষত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে চারবারের যুদ্ধ (১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯), পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে অপরিহার্য প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।বিশ্লেষক বদর আলমের মতে, “পূর্ব দিক থেকে হুমকি যতদিন থাকবে, ততদিন সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত থাকবে।”সাময়িক সমর্থন নাকি স্থায়ী ভাবমূর্তি?বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, এই জনসমর্থন সময়সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল হতে পারে। নিউইয়র্কের অধ্যাপক নিলুফার সিদ্দিকি বলেছেন, “এই সমর্থন টিকবে কি না, তা নির্ভর করছে ভারতের অবস্থানের ওপর এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপথে।”লন্ডনের গবেষক মারিয়া রশিদের ভাষায়, "আমরা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু সীমান্তে তাদের ভূমিকার প্রশংসা করতেই হবে।"পরিশেষে: সংকটে উত্থান, কিন্তু ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখন জনগণের চোখে এক নতুন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তবে, এই জনপ্রিয়তা কি কেবল যুদ্ধকালীন উন্মাদনা, নাকি বাস্তব রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত—তা সময়ই বলে দেবে।
মন্তব্য (০)