সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সংঘটিত হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’ লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এ ঘটনার মাধ্যমে আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে একটি বিতর্কিত নাম—লস্কর–ই–তাইয়েবা (LeT)। ভারত সরাসরি অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান এই গোষ্ঠীকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে, লস্কর–ই–তাইয়েবা আদতে কারা? পাকিস্তান কি সত্যিই তাদের মদদ দেয়?লস্কর–ই–তাইয়েবা কী এবং কীভাবে গঠিত হয়েছিল?১৯৮৬ সালে পাকিস্তানে গঠিত লস্কর–ই–তাইয়েবা একটি জঙ্গিগোষ্ঠী, যেটি বিশ্বের অনেক দেশ ও সংগঠনের চোখে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত। এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে ‘মারকাজ দাওয়াত–উল ইরশাদ’ নামে একটি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের সামরিক শাখা হিসেবে। পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক জিয়াউল হকের ইসলামীকরণ নীতির অংশ হিসেবেই এর জন্ম, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে বৈশ্বিক ইসলামী রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত করা।লস্কর–ই–তাইয়েবা কেবল কাশ্মীরে স্বাধীনতার নামে লড়াই করে না, বরং তাদের মূল লক্ষ্য হলো একটি ‘বিশ্বব্যাপী ইসলামি খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা, যেখানে ইসলামি ভূমি পুনরুদ্ধারকে কেন্দ্রীয় ইস্যু হিসেবে দেখা হয়।লস্কর–ই–তাইয়েবার আলোচিত হামলা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া২০০১ সালে ভারতের সংসদে হামলা এবং ২০০৬ সালে মুম্বাইয়ে ট্রেন বিস্ফোরণ এই গোষ্ঠীর বড় হামলার তালিকায় স্থান পেয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলায়, যেখানে ১৬৬ জন নিহত হয়, যার মধ্যে বিদেশিরাও ছিল। ভারত এই হামলার জন্য সরাসরি লস্কর–ই–তাইয়েবাকে দায়ী করে। হামলার সময় একটি ইহুদি উপাসনালয়ে হামলা চালিয়ে তারা নিজেদের চরমপন্থী ইহুদিবিদ্বেষও প্রকাশ করে।লস্করের প্রধান ও দাতব্য আড়ালে পুনরায় আত্মপ্রকাশএই গোষ্ঠীর প্রধান হাফিজ মুহাম্মদ সাঈদ, যিনি পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের দায়ে পাকিস্তানে ৩১ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পাকিস্তান সরকার লস্করকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ‘জামাত-উদ-দাওয়া’ নামের দাতব্য সংগঠনের মাধ্যমে আবারও সক্রিয় হয় গোষ্ঠীটি। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, লস্কর ও জামাত-উদ-দাওয়া আদতে একই সংগঠন, নাম বদলে
কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।জইশ–ই–মুহাম্মদ: লস্করের সহযোগী আরেক জঙ্গিগোষ্ঠীমাওলানা মাসুদ আজহার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জইশ–ই–মুহাম্মদ (JeM) ২০০১ সালের সংসদ হামলার অন্যতম অভিযুক্ত সংগঠন। যদিও ২০০২ সালে পাকিস্তান এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে, তথাপি তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে এর সংযোগ ছিল বলে জাতিসংঘ জানায়।পাকিস্তান ও লস্কর–ই–তাইয়েবার সম্পর্ক: সত্য নাকি সন্দেহ?বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের আইএসআই (Inter Services Intelligence) ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে লস্কর–ই–তাইয়েবার সম্পর্ক বহুদিনের এবং জটিল। আশির দশক ও সোভিয়েত-বিরোধী আফগান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান এই গোষ্ঠীগুলোকে প্রক্সি যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করেছে।বিশ্বখ্যাত নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যাশলি টেলিস এক প্রবন্ধে লেখেন, “লস্কর–ই–তাইয়েবা শুরু থেকেই পাকিস্তানের আস্থাভাজন ছিল। আফগানিস্তান ও ভারতের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের ব্যবহার করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।”২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার সময় মার্কিন নাগরিক ডেভিড হেডলি স্বীকার করেছিলেন, তিনি পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে হামলার সমন্বয় করেছিলেন। যদিও পাকিস্তান সরকার তা অস্বীকার করে, তবে বিষয়টি বিতর্কের বাইরে নয়।রাষ্ট্রের শত্রু নয়, বরং রাষ্ট্রের সহযোগী?বিশ্লেষক স্টিফেন ট্যাঙ্কেল মনে করেন, “লস্কর–ই–তাইয়েবা পাকিস্তানের ভেতরে কোনো হামলা চালায় না এবং বরং এমন গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধেই কাজ করে, যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এমনকি তারা বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ ও নির্মূলকাজেও সহায়তা করেছে।”উপসংহার: সম্পর্ক কি শুধুই কাকতালীয়, নাকি উদ্দেশ্যপ্রসূত?যদিও পাকিস্তান বারবার বলে এসেছে যে তারা লস্কর–ই–তাইয়েবার মতো সংগঠনগুলোকে সমর্থন করে না, তথাপি তাদের প্রতি সহনশীলতা, কার্যত নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও পুনরায় সক্রিয় হওয়ার সুযোগ দেওয়া—এসব পাকিস্তানের বক্তব্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।বিশ্ব সম্প্রদায়ের চোখে, লস্কর–ই–তাইয়েবা এখন আর শুধু কাশ্মীরকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়, বরং একটি সুসংগঠিত ও আদর্শিক জঙ্গি সংগঠন, যার সঙ্গে পাকিস্তানের গভীর, জটিল এবং বহুস্তরীয় সম্পর্ক রয়েছে।
মন্তব্য (০)