রাশিয়ার সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি ইউক্রেনে টিকেছিল মাত্র ৩০ ঘণ্টা, তাও ছিল সীমিত এবং বিতর্কিত। উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, "ইস্টার ট্রুস" চলাকালীন রবিবার কোনো বিমান হামলার সাইরেন বাজেনি। তিনি বলেন, এই ফরম্যাটে যুদ্ধবিরতি ৩০ দিন বা তারও বেশি সময় পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব হতে পারে।যুক্তরাষ্ট্রও ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি আনার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেটি কখনো কার্যকর হয়নি। এই সর্বশেষ চেষ্টাটি এতটুকুই প্রমাণ করে যে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামানো কতটা কঠিন।রাশিয়া যুদ্ধবিরতির জন্য কিছু শর্ত দিয়েছিল—এর মধ্যে ছিল ইউক্রেনের নতুন সেনা সংগ্রহ ও অস্ত্র মজুদ বন্ধ করা এবং "সংঘাতের মূল কারণ" সমাধানের অঙ্গীকার।দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে বড় বাধা। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৫টি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে ইউক্রেন, যা তারা বারবার জাতীয় নিরাপত্তার গ্যারান্টির দাবি করে ব্যাখ্যা দিয়েছে।অন্যদিকে, রাশিয়া অভিযোগ করে ইউক্রেন কখনোই যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে সক্ষম নয়। তবে স্বাধীন সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হওয়ার প্রধান দায় রাশিয়ার, যদিও ইউক্রেনও পুরোপুরি দায়মুক্ত নয়।যুদ্ধবিরতির পেছনে ২০১৪ সালের আস্থা ভঙ্গ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে ১৯৯৭ সালের 'মৈত্রী, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব চুক্তি' লঙ্ঘন করে, যেখানে এক অপরের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সীমানা সম্মান করার অঙ্গীকার ছিল।ইউক্রেনের তৎকালীন সেনাপ্রধান ভিক্টর মুঝেনকো অভিযোগ করেন, রাশিয়া ২০১৪ সালে ইলোভাইস্ক শহর থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের ওপর হামলা চালায়, যাতে কমপক্ষে ৩৬৬ ইউক্রেনীয় সৈন্য নিহত হন।প্রথম প্রধান যুদ্ধবিরতি ২০১৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর 'মিনস্ক চুক্তি'র মাধ্যমে স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু চুক্তির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে যায়। ডোনেৎস্ক বিমানবন্দর এবং ডেবালৎসেভে শহরে হামলা চলতে থাকে।এরপর আসে ‘মিনস্ক-২’ চুক্তি (২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি), কিন্তু সেটিও কার্যকর হওয়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই গোলাবর্ষণ শুরু হয়। ওএসসিই’র (OSCE) পর
্যবেক্ষকরা হামলার খবর নিশ্চিত করলেও কারা দায়ী তা বলেননি।ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির দীর্ঘ তালিকাএরপর একের পর এক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসে—ইস্টার যুদ্ধবিরতি: ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮স্কুল যুদ্ধবিরতি: ২০১৫-২০১৮ পর্যন্ত প্রতি বছরবড়দিন ও নববর্ষ যুদ্ধবিরতি: ২০১৫-২০১৮রুটি সংগ্রহ যুদ্ধবিরতি: ২০১৭-২০১৯২০২০ সালের ২৭ জুলাই ঘোষিত ‘সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি’ lasted মাত্র ২০ মিনিট, কিন্তু পরবর্তী বছরে ইউক্রেনীয় সেনা মৃত্যুহার অর্ধেকে নেমে আসে, যা তাৎক্ষণিক প্রভাব বোঝায়।দায় কার?রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের সামরিক বিজ্ঞান বিভাগের পরিচালক ম্যাথিউ স্যাভিল বলেন, "রাশিয়া কখনোই আন্তরিকভাবে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে চায়নি"। তিনি জানান, "সংঘর্ষের ধরন কখনো কমেছে, আবার বেড়েছে, ইউক্রেনেরও কিছু দায় রয়েছে, তবে মূল হুমকি সবসময় রাশিয়ার দিক থেকেই এসেছে।"যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কিয়েভ দূত জন হার্বস্ট বলেন, "মিনস্ক চুক্তির সবচেয়ে বড় লঙ্ঘনকারী ছিল রাশিয়া।"স্বচ্ছতা ও সত্যের অভাবরাশিয়া-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্বাধীন সাংবাদিকদের নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ফলে নিরপেক্ষভাবে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের সত্যতা যাচাই করা কঠিন।বিবিসির সাংবাদিক ওলগা ইভশিনা বলেন, ২০১৬-১৯ সালে ইউক্রেন কিছু গ্রাম পুনর্দখল করেছিল, এবং ইউক্রেনীয় ট্যাংকগুলো নিষিদ্ধ এলাকা সীমার মধ্যে দেখা গেছে—যা মস্কোর অভিযোগকে জোরালো করে।তবে তিনি বলেন, "২০১৫ সালের ডেবালৎসেভে দখল ছিল সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন, অথচ রাশিয়া তা চেপে গেছে।"ভবিষ্যত কী?পুতিনের ‘ইস্টার যুদ্ধবিরতি’ ছিল বাস্তবে এক মুহূর্তের বিরতি মাত্র, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেছেন, "এই সপ্তাহেই ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি হতে পারে।"কিন্তু রাশিয়া এখনো তাৎক্ষণিক ও শর্তহীন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়নি। ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, "যদি কেউ আলোচনা কঠিন করে তোলে, তাহলে আমরা তা থেকে সরে আসবো।"রাশিয়ার দাবি—"সংঘাতের মূল কারণ" সমাধান না হলে তারা পিছু হটবে না, অর্থাৎ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করাই রাশিয়ার মূল লক্ষ্য।পুতিনের সাবেক উপদেষ্টা ভ্লাদিস্লাভ সুরকভ একে “মিনস্ক চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেন বিভাজনের বৈধতা প্রতিষ্ঠা” বলে উল্লেখ করেছেন।
মন্তব্য (০)