বিশ্বজগতে প্রথমবারের মতো দুইটি গ্যালাক্সিকে এক অদ্ভুত “দূরবর্তী মহাজাগতিক দ্বৈরথ” চালাতে দেখে চমকে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা।চার বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন টেলিস্কোপ ব্যবহার করে গবেষকরা দেখেন, এই দুই দূরবর্তী গ্যালাক্সি একে অপরের দিকে দৌঁড়াচ্ছে ভয়াবহ গতিতে, প্রায় ১.১ মিলিয়ন মাইল প্রতি ঘণ্টা (১.
৮ মিলিয়ন কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা) বেগে**। এর মধ্যে একটি গ্যালাক্সি তার প্রবল তেজস্ক্রিয় বিকিরণ দিয়ে অপর গ্যালাক্সির গ্যাস মেঘগুলোকে ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে দ্বিতীয় গ্যালাক্সিটির নতুন তারকা গঠনের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়।**প্যারিস ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ও ফ্রেঞ্চ-চিলিয়ান ল্যাবরেটরি ফর অ্যাস্ট্রোনমির গবেষক পাসকুয়র নোটেরডামে এই ঘটনা “কসমিক জোস্ট” বা মহাজাগতিক তলোয়ারযুদ্ধে ব্যাখ্যা করেছেন।মহাবিশ্বের প্রাচীনকালের এক বিরল দৃশ্যনোটেরডামে ও তার সহকর্মীরা যে দৃশ্যটি দেখেছেন, তা আসলে দুইটি গ্যালাক্সির মিশ্রণের অজানা এক মুহূর্ত, যা ঘটছে প্রায় ১১ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। Nature জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় উঠে এসেছে, এমন ঘটনা তখন বেশি সাধারন ছিল যখন মহাবিশ্বে তারকার জন্ম এবং গ্যালাক্সির সংঘর্ষের হার ছিল অনেক বেশি।গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশেষ আবিষ্কারচিলির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ (VLT) ও আটাকামা মিলিমিটার/সাবমিলিমিটার অ্যারে (ALMA) ব্যবহার করে গবেষকরা আবিষ্কার করেন, যেই গ্যালাক্সি থেকে প্রবল বিকিরণ আসছে তা হলো এক জ্বালামুখী কেন্দ্রীয় স্থান বা “কোয়াজার”, যা পরিচালিত হচ্ছে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল দ্বারা।নাসার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্ল্যাকহোলের চরম মহাকর্ষীয় প্রভাবের কারণে চারপাশের গ্যাস ও ধুলো লাখ লাখ ডিগ্রি তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে প্রচন্ড আলো সৃষ্টি করে। এই গ্যাস এবং ধুলো ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরে অ্যাকক্রেশন ডিস্ক তৈরি করে, আর তেজস্ক্রিয় জেটের মাধ্যমে শক্তির বিস্ফোরণ বাহিরে বেরিয়ে আসে।কোয়াজারের অতিপ্রবল বিকিরণ—পড়োয়ালার পেছনের নায়কএই কোয়াজার থেকে নির্গত আলট্রাভায়োলেট বিকিরণ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির তুলনায় হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। এর কারণে আক্রান্ত গ্যালাক্সির অনেক তারকা গঠনের উৎসস্থল থেকে হাইড্রোজেন অণুগুলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে।তারকার জন্ম হয় যখন বৃহৎ গ্যাস ও ধুলো ক্লাস্টার নিজের মহাকর্ষীয় আকর্ষণে সংকুচিত হয়। কিন্তু এই বিকিরণ গ্যাস মেঘগুলোকে এতটাই নষ্ট করে দেয় যে তারা আর নতুন তারকা গড়ার মতো ঘনত্ব বা আয়তনে থাকতে পারে না।কোয়াজারের শক্তির উৎসআক্রান্ত গ্যালাক্সির থেকে আরও গ্যাস ও ধুলো ব্ল্যাকহোলের কাছে চলে আসলে কোয়াজারের শক্তি আবার বাড়ে। গবেষক সের্গেই বালাশেভ বলেন, কোয়াজার সময় সময় “বন্ধ” হয়ে যেতে পারে, যা গ্যাস মেঘগুলিকে পুনরায় গড়ে উঠার সুযোগ দেয়।তিনি বলেন, “এটাই প্রথমবারের মতো আমরা সরাসরি কোয়াজারের বিকিরণের প্রভাব একটি কাছাকাছি গ্যালাক্সির আণবিক গ্যাসের ওপর দেখতে পেয়েছি। আগেও এটি কেবল তত্ত্বীয়ভাবে ধারণা করা হত।”অসাধারণ কোয়াজারের সন্ধানগবেষকরা এই কোয়াজারকে বিশেষ নজরে রেখেছিলেন কারণ এর স্পেকট্রা বা আলোর স্বাক্ষর অন্য অনেক দূরবর্তী বস্তুর তুলনায় বেশ আলাদা ছিল। বালাশেভ বলেন, “এটি এক ধরণের ‘ঘাসের গাদা থেকে সূঁচ খোঁজা’ ছিল।”কিন্তু কোয়াজারের আলো এতই প্রখর যে প্রায়শই তা নিজেদের গ্যালাক্সির কাছাকাছি থাকা অন্য গ্যালাক্সির আলোককে ঢেকে ফেলে, যা পর্যবেক্ষণ কঠিন করে তোলে, বলে জানান নোটেরডামে।নাসার মতে, খুব কম সংখ্যক কোয়াজার এত জোরালো ও গতিশীল হয়। ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন-এর NOIRLab-এর পোস্টডক গবেষক অ্যানিকে গ্লাউডেমান্স জানান, প্রাথমিক মহাবিশ্বে মাত্র হাজারের কিছু বেশি এমন কোয়াজার পাওয়া গেছে।নোটেরডামে বলেন, “শুরুতে আমরা বুঝতে পারছিলাম কোয়াজার ও আমাদের মধ্যে কিছু আণবিক গ্যাস আছে। কিন্তু বড় টেলিস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করার পরই বুঝতে পারলাম দুটি আলাদা গ্যালাক্সি রয়েছে।”গ্যালাক্সির দূরত্ব ও মিশ্রণনিম্নমানের স্পেকট্রায় দুই গ্যালাক্সি যেন একে অপরের ওপর ঢাকা পড়ে আছে, কিন্তু ALMA-র উচ্চ রেজোলিউশনের চিত্রায়ন দেখায় তারা হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। VLT-র মাধ্যমে গবেষকরা গ্যাসের ঘনত্ব ও দূরত্ব পরিমাপ করতে পেরেছেন, যা কোয়াজারের বিকিরণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।গবেষকরা মনে করেন, যেহেতু এই আলোক সংকেত বিলিয়ন বছর আগে থেকে এসেছে, তাই এখন হয়তো এই দুই গ্যালাক্সি একত্রিত হয়ে একটি বড় গ্যালাক্সিতে রূপান্তরিত হয়েছে, তবে নিশ্চিত হওয়া যায় না।মহাবিশ্বের অতীতের আভাসহার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের গবেষক ডং-উ কিম বলেন, কোয়াজার ও গ্যালাক্সি সংঘর্ষ আগের মহাবিশ্বে অনেক বেশি সাধারণ ছিল। কারণ তখন মহাবিশ্ব ছিল আরও ঘনত্বপূর্ণ, ফলে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের দিকে আকৃষ্ট হত।তিনি আরও বলেন, “গত কয়েক বিলিয়ন বছরে মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে, আর গ্যালাক্সিগুলো একত্রিত হয়ে বড় গ্যালাক্সি গঠন করেছে।”নোটেরডামে উল্লেখ করেন, প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর আগে মহাবিশ্বে তারকার উৎপাদন ছিল অত্যন্ত বেশি, যার কারণে তাকে ‘মহাবিশ্বের দুপুুুর সময়’ বলা হয়।কিম জানান, যদিও এখন গ্যালাক্সি সংঘর্ষ কমে গেছে, এটি এখনও ঘটে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের নিজস্ব মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আগামী কয়েক বিলিয়ন বছরে আন্দ্রোমিডা গ্যালাক্সির সঙ্গে সংঘর্ষ করবে। তবে এই ‘কসমিক জোস্ট’ বা মহাজাগতিক দ্বৈরথের মতো ঘটনা গ্যালাক্সির সংঘর্ষে কতটা সাধারণ তা এখনো পরিষ্কার নয়।তিনি বলেন, “এমন গবেষণা আমাদের মহাজাগতিক গ্যালাক্সি গঠনের প্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করবে এবং কিভাবে তারা সময়ের সঙ্গে বিকশিত হয় তা দেখতে পারব।”
মন্তব্য (০)